সরকার মোট ১০০টি দ্রব্য ও সেবার ভ্যাট হার বৃদ্ধি করে প্রজ্ঞাপন দিয়েছে। এতে ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে।
বিকেএমই সভাপতি হাতেম আলী বলেন, সরকার তিতাসের গ্যাস চুরি বন্ধ করলে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দরকার হবে না দাবি করে তিনি বলেন, ‘তিতাসের নানা সংযোগে যেসব চুরি হচ্ছে, তা বন্ধ করতে পারলে গ্যাসের দাম বাড়ানোর দরকার হবে না। তাছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির এতটাও দাম বাড়েনি যে ৩০ টাকা থেকে এক লাফে ৭৫ টাকা করা লাগবে। আমরা মনে করি সরকারের এ সিদ্ধান্ত একেবারেই ভিত্তিহীন। গ্যাসের এমন মূল্য বৃদ্ধির বিষয় আমরা আমাদের যুক্তি উপস্থাপন করব। আর যদি আমাদের সিদ্ধান্ত না মানা হয়, তাহলে ভর্তুকি দিয়ে নতুন করে আর কোনো সংযোগ নেব না।’
একটি প্রত্যক্ষ কর হচ্ছে ভ্যাট। এটি সরাসরি ভোক্তা দিয়ে থাকেন। বছরের মাঝামাঝি ভ্যাটের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার কারণে মানুষের ভোগান্তি বাড়বে। ভ্যাট হার কার্যকর হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যবসায়ীরা পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেবেন। ফলে ভোক্তা বা জনগণকে আগের চেয়ে বেশি দামে পণ্য কিনতে হবে।
কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসেন বলেন, ‘অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানো নজিরবিহীন।
তিনি বলেন, ‘মানুষ এমনিতেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট। এ সিদ্ধান্ত তাদের বোঝা আরও বাড়াবে। সরকারের রাজস্ব বাড়ানোর লক্ষ্য থাকলে কর ফাঁকি ঠেকানোর দিকে মনোযোগ দেওয়া উচিত। কর ফাঁকি রোধ করা গেলে এ ধরনের পদক্ষেপের প্রয়োজন হতো না এবং জনগণের কষ্টও লাঘব হতো।’
বাণিজ্যিক পর্যায়ে ওষুধের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর কারণে ওষুধের দামও বাড়বে। এ ক্ষেত্রে ভ্যাটের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে।
১০ শতাংশ থেকে ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার কারণে মুদ্রণ, সিনেমার টিকিট, মেরামত ও সার্ভিসিং এবং পরিচ্ছন্নতা সেবার খরচও বাড়বে।
মোবাইল ফোনের ব্যবহারের ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ২৩ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে এখন থেকে মোবাইল ফোন ব্যবহারের খরচে সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট ও সারচার্জ ৩৯ শতাংশের পরিবর্তে ৪২ দশমিক ৪৫ শতাংশের বেশি দিতে হবে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ওপর ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করায় ইন্টারনেট খরচও বাড়বে।
সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির এনবিআরের প্রস্তাব পাস করা হয়। আইন মন্ত্রণালয়ের মতামত সাপেক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পর তা অধ্যাদেশ আকারে জারি করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) অনুমোদন করা ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণের শর্তের অংশ হিসেবেও এই ভ্যাট বাড়ানোর সুপারিশ ছিল। গত সরকার ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বাজেট দেওয়ার সময়ে এক দফা ভ্যাট বাড়িয়ে ছিলো। এখন আবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ভ্যাট বৃদ্ধি করলো।
যেসব পণ্য ও সেবার খরচ বাড়বে : আগে মোবাইল ফোনের সিম বা রিম কার্ড ব্যবহারের ওপর ২০ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক থেকে ২৩ শতাংশ করা হয়েছে। ফলে মোবাইল ফোনে কথা বলা এবং ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচও বাড়বে।
ব্র্যান্ডের দোকান ও বিপণিবিতানের তৈরি পোশাকের আউটলেটের বিলের ওপর ভ্যাট সাড়ে ৭ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এ ছাড়া সব ধরনের রেস্তোরাঁর ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
শুল্ক-কর বৃদ্ধির তালিকায় আরও আছে টিস্যু, সিগারেট, বাদাম, আম, কমলালেবু, আঙুর, আপেল ও নাশপাতি, ফলের রস, যেকোনো ধরনের তাজা ফল, রঙ, ডিটারজেন্ট, মদের বিল, পটেটো ফ্লেক্স, চশমার প্লাস্টিক ও মেটাল ফ্রেম, রিডিং গ্লাস, সানগ্লাস, বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার ও তাতে ব্যবহৃত তেল, বিদ্যুতের খুঁটি, সিআর কয়েল, জিআই তার ইত্যাদি। এ ছাড়া ভ্রমণকরও বাড়ানো হয়েছে।
অভ্যন্তরীণ উড়োজাহাজের আবগারি শুল্ক ৫০০ থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হয়েছে। সার্কভুক্ত দেশের জন্য এই শুল্ক বাড়িয়ে দ্বিগুণ করে এক হাজার টাকা করা হয়েছে। এশিয়া মহাদেশের দেশে (সার্কভুক্ত দেশ বাদে) ২০০০ থেকে ২৫০০ টাকা করা হয়েছে। আর এসবের বাইরে অন্যান্য দেশে ৩০০০ টাকার আবগারি শুল্ক ৪০০০ টাকা করা হয়েছে।
নিম্ন, মধ্য, উচ্চ ও অতিউচ্চ সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক ৬৭ শতাংশ করা হয়েছে। আগে যা ছিল যথাক্রমে ৬০, ৬৫ দশমিক ৫, ৬৫ দশমিক ৫ ও ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ। স্থানীয় ব্যবসায় ভ্যাটের হার ৫ থেকে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে।
স্বয়ংক্রিয় ও যন্ত্রচালিত করাতকল, খেলাধুলার আয়োজক, পরিবহন ঠিকাদার, টেইলার্স, ভবন রক্ষণাবেক্ষণ সংস্থা, খেলাধুলার ক্লাব, বোর্ড সভায় যোগদানকারী, মোটর গ্যারেজ, ডকইয়ার্ড, ছাপাখানা, বৈদ্যুতিক খুঁটি, ইলেকট্রিক পোলের ভ্যাট ১০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
নন-এসি হোটেল, কিচেন টাওয়াল, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, মিষ্টান্ন, সানগ্লাস (প্লাস্টিক, মেটাল ফ্রেম) ও ফ্যাশন হাউজের ভ্যাট ৭ দশমিক ৫ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। রেস্তোরাঁ, ইভেন্টিং সংস্থার ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের ট্রান্সফরমার, নারিকেল ছোবড়ার ম্যাট্রেস, চশমার ফ্রেম ও রিডিং গ্লাস (প্লাস্টিক ও মেটাল), আম, আনারস, কলা, পেয়ারা ও তেঁতুলের পেস্ট বিআরটিএ থেকে সরবরাহ করা লেমেনেটেড ড্রাইভিং লাইসেন্সের ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।
চাটনি কেচাপ, হাতে তৈরি বিস্কুট, কেক, আচারের ভ্যাট হার একইভাবে বাড়ানো হয়েছে। বার ও বারযুক্ত হোটেল-মোটেলে সেবায় ভ্যাট হার ২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। কার্বোনেটেড ও নন-কার্বোনেটেড পানীয়তে যথাক্রমে ৩০ শতাংশ ও ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসানো হয়েছে। বিভিন্ন ফল ও বাদামে ভ্যাট ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে।
ডিটারজেন্ট ১০ শতাংশ ভ্যাট বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ, সাবানে ১৫ শতাংশ ভ্যাট বাড়িয়ে ৬০ শতাংশ, পেইন্টস ও ভার্নিসে ১০ শতাংশ ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে।
এনবিআরের প্রজ্ঞাপন : গত বৃহস্পতিবার রাতে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এক প্রজ্ঞাপনে মোবাইল ফোন ব্যবহার, ইন্টারনেট, টিস্যুসহ প্রায় ১০০টি পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) ও সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা দেয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, আজ শনিবার থেকে এটি কার্যকর হবে।