Search
Close this search box.

বাংলা ও বাঙালির ইলিশের আখ্যান

বাংলা ও বাঙালির সাথে সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ ভাবে যে সকল শব্দ জড়িয়ে আছে তার ভেতর সবচেয়ে মৌলিক ও বাঙালিআত্মিক একটি শব্দ হচ্ছে মাছে -ভাতে বাঙালি। যদিও এখন সে শব্দটি বিবর্তিত হয়ে ভাতে আর ভাতে বাঙালি হয়ে উঠছে কিন্তু একটা সময় কিন্তু এরকমটি ছিলো না। তখন খাবারের পাতে ভাতের চেয়ে মাছের সংখ্যাই থাকতো বেশি বরং তৎকালীন সময়ে মাছের তুলনায় ভাতের অভাবই ছিলো বেশি কারণ দীর্ঘ বন্যার কারণে কৃষক ধান ঘরে তুলতে পারতো না। সেই মাছে ভাতে বাঙালির ভোজন পার্বণে যে মাছটি তার রাজত্ব বিস্তার করেছে সমগ্র বাংলা জুড়ে সেই রাজার নামই হচ্ছে রুপালি ইলিশ। গায়ের রং তার রুপোলী অলংকারের সবটুকু সৌন্দর্য দিয়ে আঁকা আর ঠোঁট যেন তার গোলাপের লাল পাপড়ির রক্তিম কিরণে উজ্জ্বল। তার গায়ের ঘ্রাণ নিয়ে আজো কত লৌকিক রটনা রটে বেড়ায় গ্রাম বাংলার পথে প্রান্তরে, নতুন জামাইয়ের হাতে ইলিশ না থাকলে নাকি জামাইয়ের জাম-উচ্চ সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যেতো শশুর বাড়িতে। ইলিশের শরীরের ঘ্রাণে ভূত-প্রেতরাও নাকি পাগল হয়ে মাছ কিনে বাড়ি ফেরার পথে হাঁটরের পিছু পিছু বিড়ালের রূপ ধরে একদম গৃহস্থের বাড়ি পর্যন্ত এসে পৌঁছায় এবং সেই মাছ কাটার পর যে অবশিষ্ট অংশ ফেলে দেওয়া হয় সেটা তারা খেয়ে নেয় এমনই গল্প আজও প্রচলিত বাংলার গ্রাম অঞ্চলে।। এই হচ্ছে তার রূপ, বর্ণ, ঘ্রাণের আদ্যপান্ত যা তাকে করেছে সকল মাছের থেকে আলাদা ও ভিন্ন তার রাজত্ব ধরে রাখার জন্য যথেষ্ট এই সকল গুন।

পদ্মার পার ঘেঁষেই আকোটের চর গ্রাম। পদ্মার এই অংশের ইলিশের স্বাদের কথা শুনেছি আমার দাদার মুখে। আমার দাদারা দুই ভাই তারা এই পদ্মায় ইলিশ মাছ ধরেছে ঝাঁকে ঝাঁকে এমনও হতো যে আধা কেঁজি ওজনের মাছ তারা ছেড়ে দিতো কারণ এতো এতো বড় বড় মাছ উঠতো যে কম ওজনের মাছ ধরলে বড় মাছগুলো নিতে পারতো না তারা বা ছোট মাছ তেমন কেউ কিনতে চাইতো না। তানা ধরতো শুধু এক কেজি ও তার চেয়ে বেশি ওজনের মাছগুলো। দুই তিন কেজির পরিমাণ ইলিশ মাছ অনেক পাওয়া যেতো তখন। মাছ ধরে পাশের পিয়াজখালি হাটে বিক্রি করে আবার জাল নিয়ে নদীতে নামতো। আমাদের অঞ্চলে পিয়াজখালি হাট ছিলো তখন নৌ বানিজ্যের মূল কেন্দ্র। দূর দূরান্ত থেকে মানুষ এই হাটে আসতো এবং পদ্মার তাজা ইলিশ কিনে আনন্দ বাড়ি নিয়ে যেতো। মাসের পর মাস এভাবেই দাদারা মাছ ধরতো আবার বিক্রি করতো এমনই ছিলো বাংলার মানুষের জীবন। এগুলো কোন গল্প কাহিনি নয় এগুলো এক সময়ের বাংলার অবিরাম চিত্র ছিল। অথচ আজ মানুষ ইলিশ খেতে পারে না। ইলিশের অপর্যাপ্ততা সর্বময়। নদী শুকিয়ে গেছে মাছ ইলিশ তার প্রজনন ক্ষমতা হারাচ্ছে। ডিম ছাড়ার সময় ধরে ফেলা হচ্ছে মা ইলিশদের যা আমাদেরকে আরো ইলিশ শুন্যতার দিকে ধাবিত করছে। ইলিশের প্রজননের সময় যদি তাদের জন্য ভয়হীন পরিবেশ নিশ্চিত করতে না পারি তাহলে আমরা ভবিষ্যতে সুস্বাদু ইলিশ থেকে গলাধাক্কা সমেত বঞ্চিত হবো।
ছোট বেলায় বাড়িতে যদি ইলিশের ভাতুরী রান্না করা হতো তাহলে বাড়িময় ইলিশের ঘ্রাণ রাতের হাসনা হেনা ফুলের মত মৌ মৌ করে সারা বাড়ি ময় ছড়িয়ে পড়তো। পাশে বাড়িগুলোতেও যদি ইলিশ জাল দেওয়া হতো সে ঘ্রাণও উড়ে উড়ে নাসিকা দিয়ে ঢুকে উদরের ঠিক মাঝ বরাবর প্রচন্ড ঝাপটায় ধাক্কা দিতো। সেই ঘ্রাণ সেই স্বাদ সেই ইলিশ এখন আর নেই বললেই চলে।

দাদী বলতো তোর দাদা যখন মাছ ধরা শেষ করে বাড়ি ফিড়তো তখন সবচেয়ে বড় তিন-চারটা মাছ এনে আমার হাতে দিয়ে বলতো দুইটা দিয়ে ইলিশের ভাতুড়ী করবা আর বাকিটা রান্না করবা। বাড়ির সবার মনের ভেতর তখন আনন্দের জোয়ার বয়ে যেতো। ইলিশ মাছের তেলে তরকারি ঘ্রাণে এক অন্য রকম তৃষ্ণা সৃষ্টি করতো। বাবা-চাচা দাদী ফুফুরা সবাই মিলেমিশে এক সাথে হৈচৈ করে সেই মাছ দিয়ে পেট ভরে ভাত খেতো।

আজ থেকে মোটামুটি নয়শো বছর আগে জীমূত বাহন তার কাল বিবেক গ্রন্থে প্রথম এই মাছের নাম দিয়ে ছিলেন ইলিশ। “ইলো” মানে হচ্ছে জল আর ইশো মানে হচ্ছে রাজা সেই জলের রাজা থেকেই পরবর্তীতে হয়ে উঠেছে মাছের রাজা। ইলিশের স্বাদ জায়গা ও পানি ভেদে আলাদা আলাদা হয়ে থাকে গঙ্গার, ইলিশ, মেঘনার ইলিশ, সমুদ্রের ইলিশ এই সবগুলোর মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয় পদ্মার ইলিশকে। ইলিশ মূলত সমুদ্রের মাছ তবে ডিম পাড়ার জন্য সে অনেক পথ পরিভ্রমণ করে মিষ্টি পানিতে আসে। আর এই সময়টাকে ফাঁদ হিসেবে বিবেচনা করে সবাই ডিমওয়ালা মাছগুলোকে ধরে ফেলে যা ইলিশ ঘাটতির জন্য অনেক বেশি দায়ী।

গুন যার সীমাহীন তারও থাকে কিছু বদনাম যেমন চাঁদেরও থাকে কলঙ্কের দাগ। ঠিক তেমনি তার সেই কলঙ্কের দাগ এঁকেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী তার ইলিশ নিয়ে গল্পে! ” তখন দিল্লির মসনদে রয়েছেন মোহাম্মদ বিন তুঘলক। নানা তুঘলকি কাজকর্মে তিনি সবার কাছে পাগলা রাজা। তার রাজত্ব কালে একবার গুজরাটে বিদ্রোহ মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। আর সেটা দমন করতে হবে তাই সেনা বহর নিয়ে জলপথে তুঘলক চললেন গুজরাটে। জলাভূমির ভেতর দিয়ে তুঘলকের নৌবহর ভীষণ তেজে চলছে হঠাৎ -ই এক মাছ লাফিয়ে পড়লো নৌকায়। ঝকঝকে রুপালি রং ছিপছিপে শরীর সম্রাটের তো খুব কৌতূহল এটা কী মাছ এক রূপবতী মাছ হয় নাকি! কেউ- ই মাছ চিনে না কেউ বলতে পারলো না এটা কী মাছ। যে মাছই হোক তুঘলকের খেতে ইচ্ছে হলো সেই মাছ। এখনই এটা রান্না করে আমার সামনে হাজির করো আমি খাবো। সবাই তো আতঙ্কে একে -অপরের চোখের দিকে তাকালো। কোথাকার কী মাছ ঠিক নেই বিষাক্ত না-কী যাচাই না করেই এটা খাবে। সবাই অনেক বোঝানোর পরেও তুঘলকের মন সরলো না এই মাছ খাবেই। যাক পরিশেষে মাছ রান্না হলো এবং তুঘলক পেট ভরে খেলেন। তারপরই শুরু হলো পেটের অসুখ এবং তার কিছুদিনের মাথায়ই তুঘলক মারা গেলেন। আর সেই মাছটির নামই ছিলো ইলিশ আর গুজরাটিদের কাছে পাল্লা। দিল্লি দরবারের সবাই নাম দিলেন খুনে মাছ। আর এভাবেই বদনাম ঘারে চড়লো ইলিশের।

আরেক ইলিশ প্রেমী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখছেন- স্বামী বিবেক আনন্দ তখন সয্যাশায়ী তার খুব ইলিশ মাছ খেতে ইচ্ছে করেছে পরে তাকে ভাঁজা ইলিশ মাছের সাথে মাছ ভাঁজার অবশিষ্ট সরিষার তেল ও শুকনো লংকা দিয়ে ভাত দিলো। সেই ভাঁজা মাছ আর ভাত খেয়ে তিনি শরীরে শক্তি ফিরে পেলেন আর তৃপ্তির সাথে সকলের সাথে অনেক গল্পও করলেন।

সাহিত্যকরা প্রায় কেউ ই তাদের লেখায় ইলিশকে বাদ দিতে পারেননি। মানিক বন্দোপাধ্যায়, সতীনাথ ভাদুড়ি, বুদ্ধদেব বসু থেকে বন্ধুদেব গুহ, প্রেমেন্দ্র মিত্র, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাদের লেখায় বারবার ঘুরে ফিরে ইলিশের নাম এসেছে। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল, মনসা মঙ্গলের মত গ্রন্থেও ইলিশের উল্লেখ রয়েছে।

তাই ইলিশ রক্ষার্থে আমাদের যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। ইলিশের ডিম ছাড়ার সময় যখন ইলিশ ধরার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় তখন সম্পূর্ণ ভাবে ইলিশ মাছ ধরা বন্ধ রাখতে হবে। ইলিশের জন্য ডিম ছাড়ার সময়টা অভয়ারণ্যে পরিনত করতে না পারলে ভবিষ্যৎ এ আমরা এই ইলিশ থেকে পরিপূর্ণ ভাবে বঞ্চিত হবো তাতে কোন সন্দেহ নেই। এই বিষয়ে সকলের সম্মিলিত ভাবে এগিয়ে আসতে হবে এবং ইলিশ রক্ষায় সকলকে সচেতন করতে হবে।

কাজী বনফুল – সহ সম্পাদক দৈনিক সংবাদ প্রবাহ, লেখক ও কলামিস্ট।